স্বদেশ ডেস্ক:
গত বছরের ২২ জানুয়ারি ই-পাসপোর্ট কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনার কারণে উদ্বোধনের দুই মাস পর থেকেই আবেদন গ্রহণ ও পাসপোর্ট প্রদান কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়। এর পর সেপ্টেম্বর থেকে ফের পুরোদমে কাজ শুরু হয়। এ সময়কালে ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৪২৫টি ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট বা ই-পাসপোর্ট প্রস্তুত হয়েছে। এর মধ্যে কোয়ালিটি কন্ট্রোল বা কিউসি উত্তীর্ণ না হওয়ায় কিছু পাসপোর্ট বাদ দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্তভাবে প্রস্তুতকৃত ই-পাসপোর্টের মধ্যে ৩ লাখ ৮৩ হাজারটি গ্রাহকের হাতে পৌঁছে গেছে। আর পুলিশ প্রতিবেদনের জন্য আটকে আছে ৪০ হাজার ১৮৮টি ই-পাসপোর্ট। তথ্যগত ভুলের জন্য আটকে আছে ১৯ হাজার ৬০৭টি। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে ৬ লাখ ৩ হাজার ই-পাসপোর্টের আবেদন ঝুলে আছে। ই-পাসপোর্ট গ্রহণে বেশ আগ্রহ রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে; কিন্তু এক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ ও ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে বিস্তর।
কেন গতি নেই? কবে গতি ফিরবে? এসব ছাড়াও ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে করণীয় প্রসঙ্গে আমাদের সময়ের কথা হয়েছে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তারা বলছেন, শিগগির ই-পাসপোর্ট কার্যক্রমে গতি ফিরে আসবে। সেভাবেই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবাই এখন বেশ তৎপর।
ই-পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশিসংখ্যক আবেদন জমা পড়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে তথ্যগত ভুলের কারণে যথাসময়ে ই-পাসপোর্ট সরবরাহে কিছুটা জটিলতা ছিল। সেসব কেটে যাচ্ছে, তবে ধীরে ধীরে। যে কোনো কাজ নতুনভাবে শুরু করার সময় পুরোপুরি বুঝে উঠতে সময় লাগে, এ জন্যই গতি পেতে বেশি সময় লাগছে। এক্ষেত্রে তারা জাতীয় তথ্যভা-ারের (এনআইডি) কথাও তুলে ধরছেন। বলছেন, এনআইডির সার্ভারে শুরুর দিকে একসেস সমস্যা ছিল। আর একসেস সমস্যা থাকলে এনআইডি কার্ড সঠিক কিনা যাচাই করা সম্ভব নয়। আর যাচাই না করে পাসপোর্ট দেওয়াও অসম্ভব।
ই-পাসপোর্ট অ্যান্ড অটোমেটেড বর্ডার কন্ট্রোল ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, কারও কারও ক্ষেত্রে দেখা গেছে- এনআইডি, জন্ম সনদ ও পুলিশ প্রতিবেদনে তথ্যের ভিন্নতা রয়েছে। ইচ্ছাকৃত ভুল তো বটেই, অনিচ্ছকৃত ভুলও থাকে। এমন অবস্থায় আমাদের সিস্টেম সেটি অ্যাকসেপ্ট করবে না। কারণ ই-পাসপোর্টের পুরো প্রক্রিয়াই স্বয়ংক্রিয়; ম্যানুয়ালি কিছু করা যায় না। এমন আরও অনেক কারণ রয়েছে, যার জন্য সময় বেশি লাগছে। তবে ধীরে ধীরে হলেও সমস্যাগুলো একের পর এক কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৮ হাজার পাসপোর্ট প্রয়োজন। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিদিন গড়ে ১৮ থেকে ২৫ হাজার ই-পাসপোর্ট প্রস্তুতে সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশেই স্থাপন করা হয়েছে কারখানা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে করোনা মহামারীর মধ্যে অন্যান্য অফিস বন্ধ থাকলেও তৎপর ছিলেন ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। করোনার ভয়াবহ প্রকোপের মধ্যেও গত বছরের মে মাস থেকে প্রযুক্তি-সরঞ্জাম স্থাপন শুরু করেন তারা।
ই-পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের জন্য বর্তমানে সারাদেশের ৭০টি অফিস থেকে সেবা প্রদান করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের ৮০টি মিশনেও এমন সেবা দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের কর্মকর্তা লে. কর্নেল সাব্বির আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, তথ্যগত বিভিন্ন ভুলের কারণে অনেক বেশি সময় লাগছে। কারণ তথ্যে গড়মিল থাকলে আমাদের সিস্টেম তা গ্রহণ করে না। এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষেরও সচেতন হতে হবে। এর পর তিনি যোগ করেন- আমাদের ক্যাপাসিটি এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আশা করছি আগামী দিনে দ্রুততম সময়ে সবাই ই-পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন।
প্রস্তুত ই-গেট
ই-পাসপোর্টের মাধ্যমে দ্রুত সময়ে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ই-গেট স্থাপনের কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। প্রকল্পের আওতায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৫টি ই-গেট স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি ডিপারচার, ৩টি অ্যারাইভাল। আরও ৩৫টি ই-গেট বসবে চলতি বছরের মধ্যেই।
মিলছে এমআরপি পাসপোর্টও
ই-পাসপাপোর্ট প্রকল্প চালু হলেও এখনো মিলছে মেশিন রিডেবেল পাসপোর্ট (এমআরপি)। সেবাগ্রহীতারা নিজেদের ইচ্ছা মতো ই-পাসপোর্ট অথবা এমআরপি, যে কোনো একটি বেছে নিয়ে আবেদন করতেন পারছেন। একটি নির্দিষ্ট সময় পর এমআরপি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে এমআরপি চালু থাকলেও ই-পাসপোর্টের প্রতি আবেদনকারীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে অথবা জরুরি প্রয়োজনে এখনো এমআরপিই ভরসা।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘মনে করুন কোনো গুরুতর অসুস্থ রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে হবে। তখন ওই ব্যক্তির জন্য স্বল্পতম সময়ে এমআরপি পাসপোর্ট করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ ই-পাসপোর্ট সফটওয়্যার সিস্টেম নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সেখানে নির্দিষ্ট সময়ের আগে কোনোভাবেই পাসপোর্ট তৈরি করা সম্ভব হয় না। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যেহেতু ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে এখনো কিছু জটিলতা রয়েছে, সেক্ষেত্রে এমআরপির সুযোগটি বহাল রাখা হয়েছে।
এ জন্য গত বছরের ১৮ নভেম্বর অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি ৪০ লাখ এমআরপি পাসপোর্ট সরাসরি প্রক্রিয়ায় কেনার প্রস্তুাব অনুমোদন দেয়। ওই অনুমোদনের পর কেবিনেট বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এখন চাহিদা কম থাকলেও সরকারের লক্ষ্য ছিল ই-পাসপোর্ট চালু করা; কিন্তু কোভিডের কারণে তা বিলম্ব হয়েছে। এ কারণে আবার ৪০ লাখ এমআরপি পাসপোর্ট কিনতে হচ্ছে।৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকার এ প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৮ সাল।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বের ১১৯তম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে ই-পাসপোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটি একটি এমবেডেড ইলেকট্রনিক চিপ সংবলিত বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট। চিপের তথ্যাদি পাসপোর্টধারীর পরিচয় প্রমাণে সংরক্ষিত থাকে। এতে মাইক্রোপ্রসেসর বা চিপ এবং অ্যান্টেনাসহ স্মার্টকার্ড প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। পাসপোর্টের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চিপে সংরক্ষণ করা হয়। ই-পাসপোর্টে ছবি, আঙুলের ছাপ (ফিঙ্গারপ্রিন্ট) ও আইরিশসহ ৩৮ ধরনের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকবে। এসব বৈশিষ্ট্যের কিছু আবার থাকে লুকানো (হিডেন) অবস্থায়। তাই জালিয়াতি করা কঠিন।